ঢাকাবুধবার, ১লা মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

দুই যুগে ৭৭ ধাপ নেমেছে বাংলাদেশের ফুটবল

বাংলালাইভ ডেস্ক
জুলাই ৭, ২০২০ ৫:৫৫ অপরাহ্ণ
Link Copied!

স্পোর্টস ডেস্ক । বাংলালাইভ২৪.কম

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর, ১৯৭২ সালে গঠন হয়েছিল বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে)। দুই বছর পর ১৯৭৪ সালে এশিয়ান ফুটবল কনফেডারেশনের (এএফসি) সদস্য হয় বাংলাদেশ এবং ফিফার সদস্য পদ পায় আরো দুই বছর পর ১৯৭৬ সালে। ১৯৯৭ সালে আঞ্চলিক সংস্থা সাউথ এশিয়ান ফুটবল ফেডারেশন (সাফ) গঠিত হওয়ার শুরু থেকেই বাংলাদেশ সদস্য।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের বয়স ৪৮ বছর। তবে ইদানিং প্রথম ৩৬ বছরের চেয়ে বেশি আলোচনায় সর্বশেষ ১২ বছর। অনেকে রসিকতা করে বলেন-ফুটবল ফেডারেশনের জন্ম কি ২০০৮ সালে?

সর্বশেষ ১২ বছর বেশি আলোচনায় আসার আছে বহু কারণে। যার তিনটি প্রধান কারণ হলো- এক. সর্বশেষ এক যুগ ধরে বাফুফের সভাপতি দেশের সর্বকালের সেরা ফুটবলার কাজী মো. সালাউদ্দিন। দুই. এই এক যুগে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশ পিছিয়েছে এবং তিন. এই এক যুগে ৬টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশ একবার শুধু সেমিফাইনাল খেলেছে। বাকি ৫ বার বিদায় নিয়েছে গ্রুপপর্ব থেকে। এ সময়ে ৪টি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক ফুটবল হলেও বাংলাদেশ মাত্র একবার ফাইনাল খেলেছে।

বাফুফে সভাপতি হিসেবে কাজী মো. সালাউদ্দিন দায়িত্ব নিয়েছেন ২০০৮ সালের ২৮ এপ্রিল। তিনি দায়িত্ব নেয়ার ১৯ দিন আগে ঘোষিত ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৮০। গত ১১ জুন ঘোষিত সর্বশেষ র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৭ নম্বরে। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে মে-এই চার মাস ১৯৭ নম্বরে ছিল বাংলাদেশ। সর্বশেষ র‍্যাংকিংয়ের হিসেবে কাজী মো. সালাউদ্দিনের সভাপতিত্বের এই ১২ বছরে বাংলাদেশ পিছিয়েছে ৭ ধাপ। ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ১১০। ১৯৯৬ সালের ২৪ এপ্রিল ঘোষিত র‍্যাংকিংয়ের ওই ১১০ নম্বরটি এখন বাংলাদেশ ফুটবলের ইতিহাস। তখন ফিফার সদস্য ছিল ১৮১ টি দেশ।

১৯৯৬ সাল থেকে ২০২০, পাক্কা দুই যুগ। এই দুই যুগে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ফুটবল পিছিয়েছে ৭৭ ধাপ। যার মধ্যে ৭০ ধাপই পিছিয়েছে কাজী মো. সালাউদ্দিন সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার আগের এক যুগে। ১৮০ থেকে কাজী সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি ১২ বছরে র‍্যাংকিং নামিয়েছে ১৮৭ তে।

১৯৯৬ থেকে ২০০৮-এই ১২ বছরে ফিফা র‍্যাংকিংয়ে বাংলাদেশের ভয়াবহ ভরাডুবি হলেও ওই সময়ে জাতীয় ফুটবল দলের কয়েকটি সাফল্য অবশ্য ছিল। যেমন- ১৯৯৯ সালে সাফ গেমসে (বতর্মানে এসএ গেমস) প্রথম স্বর্ণ জয়, ২০০৩ সালে প্রথম সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয় এবং ২০০৫ সালে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের সর্বশেষ ফাইনাল খেলে লাল-সবুজ জার্সিধারীরা।

কাজী মো. সালাউদ্দিন সভাপতির দায়িত্ব নেয়ার আগের বছর ২০০৭ দেশে প্রবর্তন হয়েছিল প্রফেশনাল ফুটবল লিগ। কয়েকবার নাম পরিবর্তন হওয়া ঘরোয়া ফুটবলের সবচেয়ে মর্যাদার আসর এখন বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ নামে থিতু হয়েছে।

বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) গত ১২ বছর লিগটা নিয়মিত করতে পেরেছে। নির্ধারিত সময়ে শুরু এবং নির্ধারিত সময়ে শেষ-ইউরোপের মতো এভাবে লিগ না হলেও ঘরোয়া ফুটবলের বিভিন্ন আসর মাঠে ছিল। এই প্রথম বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ বাতিলের খাতায়। সেটাও করোনাভাইরাস মহামারির কারণে।

ফেডারেশন কাপ, প্রিমিয়ার ও অন্যান্য লিগ, স্বাধীনতা কাপের বাইরে ঘরোয়া ফুটবলে চমক জাগানো কোটি টাকার সুপার কাপও তিনবার আয়োজন হয়েছে কাজী সালাউদ্দিনের সময়ে। ১৬ বছর বন্ধ থাকা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক গোল্ডকাপ ২০১৫ সাল থেকে আবার নিয়মিতই হচ্ছে। সর্বশেষ ৬ বছরে জাতির পিতার নামে ৪টি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট হয়েছে। প্রথমবারের মতো হয়েছে বঙ্গমাতা অনূর্ধ্ব-১৯ নারী আন্তর্জাতিক ফুটবল ফুটবল টুর্নামেন্ট। বাংলাদেশ যৌথ চ্যাম্পিয়ন হয়েছে লাওসের সঙ্গে।

গত ১২ বছরের মধ্যে ছেলেদের বয়সভিত্তিক ও নারী ফুটবলে বাংলাদেশ ভালো করেছে। জাতীয় ফুটবল দল দক্ষিণ এশিয়াতে গোত্তা খেলেও ছেলে ও মেয়েদের বয়স ভিত্তিক দল কিন্তু ছড়ি ঘুড়াচ্ছে এই অঞ্চলে। কেবল এই অঞ্চলেই নয়, এশিয়া পর্যায়েও ভালো খেলছে বাংলাদেশের ছেলে-মেয়েরা। অনূর্ধ্ব-১৬ মেয়েরা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশকে রুখে দিয়েছে। প্রথমবারের মতো অনূর্ধ্ব-২৩ পুরুষ ফুটবল দল এশিয়ান গেমসের দ্বিতীয় রাউন্ডে উঠেছিল। সেটা আবার কাতারের মতো দেশকে হারিয়ে। অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবল দল স্বর্ণ জিতেছে ২০১০ সালে ঢাকা এসএ গেমসে। ছেলেদের অনূর্ধ্ব-১৬ দল কাতারের মাটিতে কাতারকে হারিয়েছে।

ছেলেদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ দুইবার ট্রফি জিতেছে। ২০১৫ সালে সিলেটে ফাইনালে ভারতকে হারিয়ে এবং ১৯১৮ সালে নেপালে ফাইনালে পাকিস্তানকে হারিয়ে। অনূর্ধ্ব-১৮ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশ ট্রফি না জিতলেও ৩ আসরের মধ্যে দুইবারই ফাইনাল খেলেছে।

মেয়েদের সাফ অনূর্ধ্ব-১৫ চ্যাম্পিয়নশিপ হয়েছে ৩ বার। এর মধ্যে তিনটিতেই ফাইনাল খেলে একবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে বাংলাদেশ। সাফ অনূর্ধ্ব-১৮ চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুটও বাংলাদেশের মেয়েদের মাথায়। তবে মেয়েদের জাতীয় দল গত ১০ বছরে হওয়া ৫ টি সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে একবার রানার্সআপ ও ৩ বার সেমিফাইনাল খেলতে পেরেছে। নারী জাতীয় দল সাফল্য না পাওয়ার কারণ বেশিরভাগ মেয়ের বয়সই ২০ বছরের নিচে। আরো কয়েক বছর পর সিনিয়র দল পাবে পরিপক্ক ও অভিজ্ঞ ফুটবলার।

এর বাইরেও আরো কিছু অর্জনের কথা উল্লেখ করেন বর্তমান কমিটির লোকজন। যেমন-সাউথ এশিয়ান বিচ গেমস ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন, সুপার মক কাপে অনূর্ধ্ব-১৪ দলের প্লেটপর্বে চ্যাম্পিয়ন, মেয়েদের অনূর্ধ্ব-১৪ দলের দুইবার এএফসি আঞ্চলিক পর্ব চ্যাম্পিয়ন হওয়া, জোকি কাপ ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়া এবং অনূর্ধ্ব-১৬ নারী ফুটবল দলের আঞ্চলিক চ্যাম্পিয়ন হয়ে চূড়ান্ত পর্ব বা বিশ্বকাপ অনূর্ধ্ব-১৭ এর বাছাই পর্বে খেলার সুযোগ পাওয়া-ইত্যাদি।

মেসিসহ আর্জেন্টিনা দলকে ঢাকায় এনে নাইজেরিয়ার বিরুদ্ধে ম্যাচ খেলিয়ে চমক দেখিয়েছিল বাফুফে। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের ফুটবলের কতটা উন্নতি হয়েছে তা নিয়ে বিতর্ক আছে। তবে মেসিদের ম্যাচ আয়োজন করে সাংগঠনিক দক্ষতার পরিচয় দিতে পেরেছেন তারা।

কাজী মো. সালাউদ্দিনের নেতৃত্বাধীন কমিটি ১২ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়েছিল জাতীয় দল প্রথমবারের মতো ভুটানের কাছে হারায়। ২০১৬ সালের ১০ অক্টোবর থিম্পুতে এশিয়ান কাপ বাছাইয়ের ফিরতি ম্যাচে বাংলাদেশকে ৩-১ গোলে হারিয়ে লজ্জা দিয়েছিল ভুটান। বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে সেটাই ভুটানের বিরুদ্ধে প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র হার। তার এক মাস আগে হোম ম্যাচও জিততে পারেনি বাংলাদেশ। ভুটানের সঙ্গে করেছিল গোলশূন্য ড্র।

ভুটানের বিরুদ্ধে খেলা ১৩ টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের মধ্যে একটি হার ও দুটি ড্র-সবাই হয়েছে বাফুফের সর্বশেষ তিন কমিটির সময়ে। ভুটান বাংলাদেশকে প্রথম রুখে দিয়েছিল ২০০৮ সালে। সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের সঙ্গে ১-১ গোলে ড্র করেছিল বাংলাদেশ। ভুটানের বিপক্ষে ম্যাচ হারার পর রাজপথে মিছিল ও বাফুফে ভবনের সামনে মানববন্ধন পর্যন্ত হয়েছিল।

১২ বছরের কার্যক্রম থেকে অর্জনগুলো বড় করে প্রচার কাজী মো. সালাউদ্দিন হয়তো নিজেকে সফল দাবি করতে চাইবেন। কিন্তু এক জায়গায় তার কোনো জবাব নেই-সেটা জাতীয় দলের পারফরম্যান্স। এই পারফরম্যান্স বলতে বিশ্বকাপ বা এশিয়ান কাপে খেলা নয়; এই পারফরম্যান্স হলো সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতা, বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ জেতা কিংবা ফাইনাল খেলা।

যেখানে গত ১২ বছরে বাফুফের ব্যর্থতা সবচেয়ে বেশি, সেই জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ভালো করতে অঢেল অর্থও কিন্তু ব্যয় করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক ম্যাচ কিংবা টুর্নামেন্টের আগে বিদেশে অনুশীলন এবং বিদেশি কোচিং স্টাফ-এটাতো কাজী সালাউদ্দিন-সালাম মুর্শেদী, বাদল রায়রা যখন খেলেছেন তখনো পাননি। কিন্তু পাচ্ছেন হালের ফুটবলাররা। যারা ক্লাবে দুর্দান্ত খেলেন, দেশের জার্সি গায়ে জড়ালেই চুপসে যান। কাতার, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড-কত জায়গায় তাদের ক্যাম্প হয়। ফলাফল সেই যে লাউ সেই কদু-সাফের সেমিফাইনালও খেলতে পারেন না।

জাতীয় দলের পারফরম্যান্স ভালো না হওয়ার কারণেই ফিফা র্যাংকিংয়ে ডাবল সেঞ্চুরি প্রায় (১৯৭) করে ফেলেছিল বাংলাদেশ। এখন ১৮৭। কাজী সালাউদ্দিন হয়তো বলবেন-আমি ডুবন্ত ফুটবলকে টেনে তোলার চেষ্টা করেছি। সব ঠিক আছে। তবে তিনি কাজী মো. সালাউদ্দিন বলেই তার কাছে মানুষের ছিল আকাশছোঁয়া প্রত্যাশা। ফুটবল নামের জাহাজটা ডুবছে-সেটা দেখেই তো তিনি টেনে তোলার দায়িত্ব নিয়েছিলেন এক যুগ আগে। পেরেছেন কি?

১২ বছরের তিনটি কমিটি হয়তো বলবে আমাদের সময় তো মাত্র ৭ ধাপ পিছিয়েছে। সেটা বলে কিন্তু পার পাওয়া যাবে না। কারণ, তারা ফুটবলকে আগাতে তো পারেনি। কাজী মো. সালাউদ্দিনের মতো কিংবদন্তি সভাপতি ছিলেন বলেই মানুষের ছিল আকাশচুম্বি প্রত্যাশা। ‘অন্যরা ব্যর্থ হয়েছে বলে আমি কেন সফল হবো না’-কাজী সালাউদ্দিনের জন্য এ বাক্যটাই তো মানানসই।

একটা দেশের ফুটবলের মান নির্ধারণ করে জাতীয় দলের পারফরম্যান্স। নারী ফুটবল, বয়সভিত্তিক ফুটবলের পারফরম্যান্স নিয়ে মানুষের আগ্রহ কম। বাংলাদেশ যখন সাফেরই সেমিফাইনাল খেলতে পারে না ধারাবাহিকভাবে, তখন অন্য টুর্নামেন্ট নিয়ে আলোচনা করে কি লাভ? ১২ বছর ৩৬ জন সহকর্মী (নির্বাহী কমিটি) নিয়ে কাজ করেছেন কাজী সালাউদ্দিন, যাদের বেশিরভাগই অতীতের তারকা ফুটবলার। সফলতা-ব্যর্থতা তাতো সবার চোখের সামনেই। সফলতা-ব্যর্থতা যাই হোক, ভাগীদার কিন্তু ৩৭ জনই।